মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও ব্রিটিশ ফরমুলা
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর পরই ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয় ৭১১ সালে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১১৯১ সালে আজমীরীতে। মুহাম্মদ ঘুরী তখন ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ১২০০ সালে শেষদিকে। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির বাংলার একটি সীমান্তবর্তী অঞ্চল নদিয়া জয়ের মাধ্যমে বাংলায় প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে সারা বাংলাকে একত্র করে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ স্বাধীন বাংলার মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করেন। ধীরে ধীরে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হতে শুরু করে এবং মোগল আমলে মাদ্রাসার সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যায়। সম্রাট বাবরের আমলের (১৫২৬-১৫৩০) রাজদরবারের কাগজপত্র থেকে জানা যায়, বাবরের প্রশাসন মনে করত, জনগণের শিক্ষা হচ্ছে শাসকের দায়িত্ব। আকবরের আমলে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য একটি বিশেষ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (১৬০৫-১৬২৭) একটি বিশেষ আইন জারি ছিল যে যখন কোনো বিদেশি নাগরিক বা কোনো দেশীয় ব্যবসায়ী কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করতেন, তখন তার রেখে যাওয়া ভবনগুলো মেরামত করে মাদ্রাসা কিংবা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হতো।
১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল আশি হাজার। ২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদ্রাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ : মে-২০০২, পৃ. ৩-৪) মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল তা উপরে উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেখলেই প্রতীয়মান হয় কিন্তু এদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ইংরেজরা মুসলমানদের ধর্ম শেখানোর জন্য কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। মোগল আমল থেকেই মাদ্রাসার শিক্ষিত ছাত্ররাই কাজী, এসেসর ও জজ ইত্যাদি পদে নিযুক্ত হতো। পরে তাও না হওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল করার ব্যাপারে সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়। জীবিকার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ছাত্ররা যাতে একটা পথ খুঁজে পেতে পারে এজন্য আলিয়া মাদ্রাসাতে ইলমে ত্বিব (হেকিমি চিকিৎসাবিদ্যা) সিলেবাসভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেষাবধি শুধু ধর্ম শিক্ষার জন্যই এই মাদ্রাসা কোনো রকমে টিকে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ছিল মুসলমানদের আসল শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু কালক্রমে ইংরেজরা এর পাশাপাশি একটি বিকল্প শিক্ষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ গড়ে তোলে এবং ইসলামী শিক্ষাকে দুটি ধারায় বিভক্ত করে আলিয়া ও কওমি। পূর্বের বেশিরভাগ মাদ্রাসাই কওমি গড়নার ছিল।
তাই মুসলমানদের চিরতরে দাসত্বের বেড়াজালে বন্দী রাখার জন্য কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন : ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার মুসলিম অধ্যক্ষ ছিলেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ১৪৭ বছর পর ১৯২৭ সালে নিযুক্ত শামসুল উলামা কামালুদ্দিন আহমদ। অর্থাৎ ১৭৮০ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মোট ২৬ জন খ্রিস্টান পন্ডিত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছে। তাহলে এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত সুপরিকল্পিতভাবে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকৃত করেছে এবং যখনই তারা মনে করেছে আমরা পুরোপুরি সফল ঠিক তখনই তারা কোন মুসলিম আলেমকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিমান অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস গুরুত্ব পেয়েছে, যেমন দাঁড়ি, টুপি, জুব্বা, মিসওয়াক, হায়েজ, নেফায়েজ, বাহাস ও বউ তালাকের ফতুয়া। কিন্তু তাওহীদ ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ কে ব্যক্তিগত ইবাদত ও বন্দেগীতে পরিণত হয়ে। যেখানে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুম দাতা নেই সেখানে আমরা শিখছি আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আবার যেখানে সাহাবী আজমাইন জিহাদ মানে দুনিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা বুঝতেন সেখানে আমরা মনের বিরুদ্ধে জিহাদকে বড় জিহাদ বুঝতে শুরু করেছি। কাজেই এই দিক থেকে ব্রিটিশরা শতভাগ সফল আর আমরা বিফল। যেখান হুকুমদাতা হচ্ছে উপাস্য আর জিহাদ হচ্ছে ব্যক্তিগত জিনিস সেখানে কি করে মুসলমানরা বিশ্ব জয় করবে? দের হাজার বছর আগে মুসলমানরা অর্ধ পৃথিবীর শাসন করত আর এখন নিজের দেশেই ওরা পরাধীন। সুতরাং এটাই প্রতিমান হয় যে বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা বিশ্ব নবীর সিলেবাস অনুযায়ী নয়, তা সম্পূর্ণ ব্রিটিশদের মনগড়া শিক্ষা ব্যবস্থা। তা না হলে আলেমসমাজে কেন এত অনৈক্য? হাজারো দলে বিভক্ত ওরা, একে অপরকে ঘৃণা হিংসা আর গীবত পরচর্চায় ব্যস্ত। যদি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সঠিক হয় তাহলে সকল আলেম ওলামাগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রমাণ করুন, তবেই বুঝবো আপনারা সঠিক।
কেননা বিশ্ব নবীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সারা আরব এক হয়েছিল যখন আরবে জাহিলিয়াতে ভরপুর ছিল। আর এখন আল কোরআন ও আল হাদিসের বাণী চিরন্তন কিন্তু নেই আলেমদের মধ্যে কোন ঐক্য। আর ব্রিটিশরা তাই চেয়েছিল যেন মুসলমানরা কোনদিন ঐক্য হতে না পারে। কেননা তারা রীতিমতো মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে জমের মতো ভয় পেতো। কারণ অল্প সময়ের ব্যবধানে গুটা ইউরোপে ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল এবং ইসলামী সাম্রাজ্য কায়েম করেছিল। তাই সুকৌশলে মুসলমানদের বিকৃত ইসলাম শিক্ষায় দীক্ষিত করে ইসলামী বিপ্লবের চেতনাকে চিরতরে ম্লান করে দিয়েছে। যার ফলে রাজত্ব হারানোর পাশাপাশি মুসলমানরা গোলামে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে উপমহাদেশে যে ইসলাম দেখছেন তা ব্রিটিশের শেখানো বিকৃত ইসলামের আধুনিক ভার্সন মাত্র, সে জন্যই এত গ্রুপিং আর বাহাস। একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারের সাথে বাহাস করেছে আপনি দেখবেন না, একজন ইঞ্জিনিয়ার আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখবেন না, আপনি দেখবেন না কোন ল’য়ারকে এমনটি করতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের আলেম সমাজে এটা অহরহ ব্যপার।
অতএব আলেম সমাজ যদি প্রকৃত ইসলামকে বুকে ধারণ করে তাহলে দেখবেন কোথাও আর বাহাসের নামে বিতর্ক ও দলাদলি নেই, নেই কোন দ্বন্দ্ব, কেবল ভাতৃত্ব বোধ আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
লেখকঃ ড. ইঞ্জি. এম. শাহেদুল ইসলাম।
Leave a Reply